Post

হিউস্টন, উই হেভ এ প্রব্লেম

Posted: September 7, 2019
Written by: Md Abdus Sami Akanda
“একুয়ারিং এসকেইপ ভেলুসিটি অফ আর্থ ইন টি মাইনাস টেন সেকেন্ড। টেন, নাইন, এইট..” বিড়বিড় করতে করতে ইয়ারফোনের প্যাঁচ খুলতেছিলাম। “ওয়ান জিরো” ইয়ারফোনের প্যাঁচ খুলল না। “হিউস্টন, উই হেভ এ প্রব্লেম। দ্য রাইট ইঞ্জিন ইস জেমড।” বলতে বলতে প্যাঁচ খুলে গেলো। আর কানে লাগিয়ে আমি ছাড়লাম “ও যে মানে না মানা”। আমি যেন এই রাস্তার হর্ন আর চেঁচামেচি থেকে অন্য এক জগতে। সকালে উঠেছিলাম অলিম্পিয়াড এর প্রোমোশনাল কাজে। সাধারণত সকালে উঠা হয় না। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠে যাই সকাল সাতটায়। সময় দেখে এক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করেই দেখি দুপুর বারটা বাজে। তখন ঝিমাতে ঝিমাতে ব্রাশ করি। আজ এতো সকালে আগে উঠার পর দেখি সব কিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। মনে হচ্ছিল এতো কম মানুষ কেন এখানে? সময় কেন জানি শেষ হচ্ছে না। গান শুনে দেখি। ঢুকলাম ইউটিউবে। ঢুকা মাত্রই সাজেশন দিলো “ও যে মানে না মানা”। এই গানটা তখন থেকে মাথায় ঢুকে গেছে। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আজকে সারাদিন এই গানটাই শোনা হবে। এখন সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। এখনও ওই গানই শুনতেছি। নিজেকে কেন জানি ছ্যাঁচড়া মনে হচ্ছিল। এই গান অনেক আগেও কয়েকবার শুনেছি। আজকে কি মনে করে ভালো লেগেছে। আজ সারাদিন ছ্যাঁচড়া প্রেমিকের মত এর সব প্রেম শুষে নিয়ে এরপর নতুন কোনো গান শুনবো।

টিউশনে যাবার জন্য অটোবাইকে উঠলাম। এক ছেলে এসে হাত ধরে টানছে। আমি কানের ইয়ারফোন খুললাম না। ঠোঁট পড়ার চেষ্টা করলাম। বলছে, পাঁচটা টাকা দেন। অটো টেনে ধরে আছে, যেতে দিবে না। মানিব্যাগে দুই টাকার নোট ছিলো। দিলাম সে চলে গেলো। কিন্তু তারা একটা দল হিসেবে বের হয়েছে। অন্য আরো দুইটা ছেলে এসে আমার হাত ধরে টানা শুরু করলো। মুসিবতে পড়ে গেলাম। আমার কাছে এক হাজার টাকার নোট আর দশ টাকা আছে। দশ টাকা অটো ভাড়া দেয়া লাগবে। এটা দিয়ে দিলে সমস্যাতে পড়ে যাবো। কিন্তু আল্লাহ ভিখারির সাথে খারাপ ব্যবহার করতে না করেছেন। (ওয়া আম্মাস সায়েলা ফালা তানহার। ৯৩ নং সূরা ওয়াদ্ব- দ্বোহা, আয়াত-১০)। কি করি? চিন্তা করতে করতে অটোওয়ালা মামা একটা দুই টাকার কয়েন হাতে দিলো ছেলেটার। আমি ভাবতে লাগলাম, আমি তো এক হাজার টাকা দিয়ে দিতে পারতাম। তাহলে হয়তো ছেলেটা গাঁজা খেয়ে টাকা শেষ করতো, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য তো সৎ থাকতো।

টিউশনে গিয়ে দেখি আমার স্টুডেন্ট তখনো ব্যাচ থেকে আসে নি। বাসায় তার ছোট ভাইবোনরা হৈ-হুল্লোড় করছে। আমি চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার স্টুডেন্টের ছোটবোন ক্লাস ফাইভে পরীক্ষা দিয়েছে। গোল্ডেন প্লাস পেয়েছে। কয়েকমাসের জন্য আমার স্টুডেন্ট ছিল সে। আমি শংকায় ছিলাম আমার সাবজেক্টে এ প্লাস পাবে কিনা। প্লাস পেয়েছে শুনে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। মাথায় তখনো ঘুরছে “ও যে মানে না মানা”। এই টিউশনের গার্ডিয়ান আমার দেখা ভাল মানুষগুলোর একজন। আমার যখন ইচ্ছা তখন এসে পড়াই। মাঝে মাঝে যাই না। কিন্তু মাস শেষে ঠিকই পেমেন্ট দিয়ে দেয়। বলা চলে টিউটরদের জন্য স্বপ্নের গার্ডিয়ান। স্টুডেন্ট এসে গেলো। কিন্তু আজকে পড়বে না। তাদের রিলেটিভ এর বাসায় যাবে। বাহ! চমৎকার। একটা ঘন্টা ফাঁকা পেলাম। কি করা যায় এই এক ঘন্টায়? এক ঘন্টা অনেক সময়। প্রেমিকাকে কল দিয়ে দেখা করা যায়। অথবা রুমে গিয়ে ল্যাব রিপোর্ট লিখে ফেলা যায়। অথবা আমার প্রোগ্রামিং এর বাকি কোডটুকু শেষ করা যায়। অথবা কাসিক্যাল মেকানিক্স এর বইটা পড়তে পারি। অনেক অপশন আছে। আমি খুবই ভাল প্রেমিক। প্রেমিকাকে কল দিলাম। “হ্যালো।” বললাম আমি।

“হুম। বলো”, সে বলল।
“বের হবা? আজকে স্টুডেন্ট পড়বে না”
“নাহ। আজকে বের হতে ইচ্ছা করতেছে না। আজকে বের না হলে হয় না?”
“ঠিকাছে। তোমার কি শরীর খারাপ?”
“নাহ। জাস্ট বের হতে ইচ্ছা করতেছে না।”
“ওকে। তাহলে আর কি? বাই?”
“বাই।”

তাহলে এখন কি করা যায়? একরকম অস্থিরতা কাজ করছে। আমি অটো থেকে নেমে হয়তো ছেলেগুলোকে নোট ভাঙিয়ে টাকা দিতে পারতাম। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখনকার ঘটনা। এতো ছোট বয়সে অনুভুতি বোঝার মত জ্ঞান ছিল না আমার। তখন নেত্রকোনা থাকতাম। মফস্বল এলাকা। ভরদুপুর সময়। আব্বা স্কুলে। আম্মা হয়তো পাশের বাসায় গিয়েছে। আমি বারান্দায় বসে কিছু একটা করছিলাম। একটা ছোট ছেলে, আমার চেয়ে ২/৩ বছর ছোট হবে, এসে বলল যে সে তার বাবার সাথে এসেছে গ্রাম থেকে। বাবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা জানতে চাইলো ওকে কিছু খেতে দেওয়া যাবে কিনা। আমার মা এমন ভাবে রান্না করত যেন সবাই খাওয়ার পর আর খাবার না থাকে। তো খাবার ছিল না। আমি বললাম, খাবার নেই। ছেলেটা বলল, আপনারা বড়লোক, আপনারাই বলেন খাবার নাই। আমি স্থম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটা হেঁটে চলে যাচ্ছে। শরীরের তুলনায় এই ছেলেটার বয়স অনেক বেশি মনে হচ্ছিলো। অনেকক্ষণ পর আমার মাথায় এলো আমার কাছে ১০ টাকা আছে, ওই সময়ে ক্লাস ফাইভের ছেলের জন্য দশ টাকা মানে দশটা বার্মিজ আচার। আমি টাকাটা নিয়ে দৌড়ে রাস্তায় গেলাম। ছেলেটা বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গেলে ধরতে পারতাম। কিন্তু রাস্তাটা আমার কাছে মনে হচ্ছিলো অনেক দূর। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বাবা-ছেলের হেঁটে যাওয়া।

Copyright © 2017 Md Abdus Sami Akanda. All rights reserved.